Saturday, June 12, 2010

ভুবনমোহিনী ভুটান ভ্রমণ


৭ই জুন ২০১০, কোলকাতা ছেড়েছি, এসেছি প্রথমে ফ্লাইটে বাগডোগরা ও সেখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে আমরা চারজন মিলে রওনা দিয়েছি ভুটানের পথে । চারজন বলতে আমার স্বামী পৃথ্বীশ, ছেলে রাহুল, আমার শাশুড়ি মা আর আমি । কোলকাতা থেকে সবকিছু ব্যবস্থা করেছেন আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট ইউনিকর্ন । কোলকাতার বহু প্রতিক্ষীত মৌসুমি বায়ু আর তার দোসর বর্ষা সুন্দরী অবশেষে আমাদের পিছু নিল । প্রথম বর্ষা ধুয়ে দিল ফুন্টশোলিং যাবার রাস্তা, মহানন্দার শুষ্ক কোলে তখন চরা পড়ে..দুচোখের চাহনিতে প্রখর তাপের রুক্ষতা । মনমরা মহানন্দায় বৃষ্টির আশির্বাদ ঝরে পড়ল । তারপরে বাঁদিকে তিস্তার কোল ঘেঁষে আর ডানদিকে পাহাড়কে ছুঁতে ছুঁতে গাড়ি ছুটে চলল ...কখনো তিস্তার অববাহিকায় বৃষ্টি নেই কখোনো চা বাগানের আঙিনায় গোধূলির কনে দেখা মেঘ চা পাতার ওপরে রঙ খেলছে । যাই হোক রোদ-বৃষ্টির এই লুকোচুরি খেলার সাথেসাথে পেরোলাম আমাদের ছোট নদী , বড় নদী, আরো নদী..ড্রাইভার বন্ধুটির কাছ থেকে নাম জানলাম সব চিল, মাঝালি, চেইল, মুরতি নদী রা আমাদের পথ দেখাল । বিকেলের শেষে তরাইয়ের জঙ্গলমহল পেরিয়ে ডুয়ার্সের রাজকীয় করিডোর পেরোলাম আমরা । আবার নদী! খরস্রোতা ডায়নায় তখন জল থৈ থৈ ! ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তখন ডায়নার বুকে নাচ করে চলেছে| সুয্যি ডোবার মূহুর্তে আমরা চা খেলাম সিঙারা সহযোগে। কিছু পরেই ভুটানগেট, এ প্রান্তে ভারত ও প্রান্তে ভুটানের ফুন্টশোলিং শহর ; ফুন্টশোলিং এ রাত কাতালাম সেন্টিনিয়াল ২০০৮ হোটেলে নাতিশিতোষ্ণ জলবায়ু রাতে চিকেন হীন চাইনিজ খেলাম চিলি মাটন এর সাথে । বার্ড ফ্লু' র জন্য ভুটানের রাজার আদেশ, চিকেন ব্যান্ড সমগ্র ভুটানে !!! ভোরে উঠেই পাহাড় পাহাড ছবি, দুচোখে মেখেনিলাম, প্রথম বর্ষার গন্ধমাখা, বৃষ্টিগন্ধ পাহাড়ের গায়ে;



৮ইজুন ভোরে হোটেলে পুরী-সবজী দিয়ে ব্রেকফাস্ট ও গরম চা খেয়ে আমরা গেলাম Royal Government of Bhutan এর immigration Office.যেখানে বহিরাগতদের জন্য পরিচয়পত্র দেখে ফোটো তুলে ভুটান শহরে প্রবেশের ভিসা প্রদান করা হয় । প্রথমে আবেদন করলাম আমরা চারজনে পারমিটের জন্য ঘন্টা খানেক পরে অনুমতি পত্র হাতে পেয়ে আবার চললাম ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে । ফুরিয়ে গেল ফুন্টশোলিং !
মেঘের কোলে রোদ আর রোদের গায়ে মেঘের উড়নিকে সঙ্গে করে মেঘের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল । পথে পড়ল ল্যান্ডস্লাইড। চড়াই-উতরাই দুর্গম এই পথ । একধারে গভীর খাদ অন্যধারে পাহাড়ের গা । এই সব বন্ধুর পথে আমাদের গাড়ির গতি কিছুটা কমে গেল। পাগলা ঝোরা দের কলকল হাসিভুলিয়ে দিল পথের বন্ধুরতা। পাহাড় গুলো যেন আরো সবুজ হতে শুরু করেছে এর মধ্যে। আর বৃষ্টির জল পেয়ে নানারকম ফুলেরা কথা বলে উঠল। আমরা পাহাড়ের ওপরে আর মেঘেরা ততক্ষণে আমাদের নীচ দিয়ে ভেসে চলেছে । পথেই পড়ল তরুণী তোর্সা । কি অপূর্ব তার রূপ লাবণ্য ! তোর্সা তবুও নবযৌবনা । ছোট্টবেলার ভূগোল ব‌ইয়ের সেই তোর্সা আমার ! আপন খেয়ালে তরঙ্গায়িত তোর্সার জলোচ্ছ্বাস নুড়িপাথরকে অবিরত চুম্বন করে চলেছে । সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে তোর্সা নেমে চলে গেল আমাদের নীচে। তখন কোনিফেরাস আর ডেসিডুয়াস বৃক্ষরাজি আমাদের অভিবাদন জানাল । মেঘের বাড়ি, মেঘের বাড়ি আর মেঘের বাড়ি পথ দেখা যায়না পথ চলা ই দায় । ইতিমধ্যে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে । তখন ১৪ ডিগ্রি সেল্সিয়াস । পথে টেক-চেইন জ্যাম নদী আর চুখা নদী যার ওপর বিখ্যাত চুখা হাইডেল পাওয়ার প্ল্যান্ট। বুনাগায়ে চিজ মোমো দিয়ে লাঞ্চ সারলাম । আবার নদী। রাজার নামে ওয়াংচু রিভার, সাথে রোদ ঝলমলে আকাশ | বিকেল ৪টের সময় ঝকঝকে রৌদ্র করোজ্জ্বল আকাশ আর মেঘ্মুক্ত বৃষ্টিহীন বাতাস নিয়ে পৌঁছালাম থিম্পুতে । 



রাজধানী শহর থিম্পু ইস্টার্ণ হিমালয়ের কোলে সাজানো ঝকঝকে শহর, উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফুট । জুনের ঠান্ডা কোলকাতার ডিসেম্বরের শুরুর মত অতি মনোরম। ৯ইজুন সকালবেলায় মেঘমুক্ত আকাশকে সঙ্গে করে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম থিম্পুর দর্শনীয় স্থান গুলি দেখতে । প্রথমেই গেলাম একটি মেমোরিয়ালে। ১৯৭৪ সালে যেটি বানিয়েছিলেন রাজা ওয়াংচুর মা । ওয়াংচু মাত্র ৪৫ বছরেই মারা যান তাই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তার মা এই বিশাল বুদ্ধ মন্দির টি বানিয়ে দেন । সেখান থেকে গেলাম টেক্স্টাইল মিউজিয়াম , ভুটান হ্যান্ডিক্রাফটস এম্পোরিয়াম । অসাধারণ ক্রাফটম্যানশিপ, নিখুঁত , দৃষ্টিনন্দন সব আর্টিফ্যাক্টস কিন্তু দাম আমাদের নাগালের বাইরে। জানিনা ইউরোপিয় টুরিস্টদের ভীড় বলে জিনিসের দাম এত বেশী কিনা । কিন্তু সাধ ও সাধ্যের নাগালে কোনো জিনিসই কেনার মত খুঁজে পেলাম না সেখান থেকে আমরা গেলাম সারবেথাং এ বোটানিকাল গার্ডেন এ । কিছুক্ষণ ফুল, আর গ্রিন হাউসে সময় কাটল । খুব সুন্দর করে সাজানো এই গার্ডেন ; আমাদের শিবপুর বোটানিকাল গার্ডেনের মত বিশালতা নেই তবে বেশ কিছু নাম না জানা ফুল দেখলাম । সেখান থেকে গেলাম পেন্টিং এন্ড স্কাল্পচার স্কুল দেখতে। কলেজের ছাত্ররা তাদের ওয়ার্কশপে বানাচ্ছে কাঠের তৈরি বিখ্যাত ভুটান মাস্ক, ড্রাগন ইত্যাদি। ধৈর্য আর নৈপুন্যের সঙ্গে বানাচ্ছে ও শিখছে তারা । কোথাও স্কাল্পচারের ক্লাস হচ্ছে । তারা মূর্তি বানাচ্ছে মোম ও ধাতু দিয়ে । হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু নেট ব্রাউসিং এর সময় পেলাম যদিও খুব কম সময় তার মধ্যেই আগের দিনে লিখে রাখা আমার ট্রযাভেলগ আপডেট করলাম । একটু রেস্ট নিয়ে ই আবার বিকেলের হালকা রোদ কে সাথী করে গেলাম টাকিন প্রিসার্ভে। টাকিন ভুটানের জাতীয় পশু । একে গোট এন্টিলোপ বলে । শাকাহারি এই পশুটি ছাগল ও গোরুর মাঝামাঝি কিন্তু কান দুটো বিশাল আর গায়ে সোনালী লোম । ঘন পাইন বনের ওপোরে তাদের রাখা হয়েছে, উঠলাম সেখানে আর তার ছবিও নিলাম । তারপর গেলাম পাহাড়ের মাথায় থিম্পু ভিউপয়েন্টে একঝলকে থিম্পুর মনোরম ভিউ দেখলাম । সব শেষে একটি বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রিতে । পাহাড় থেকে নেমে এসে হেঁটে ঘুরলাম থিম্পু ডাউনটাউন । রাতের খাওয়া সারলাম বিখ্যাত এক সুইস বেকারীতে । এটি মিড সেভেনটিস এ তৈরি হয়। এখনো ঠাত টি বজায় আছে। আমাদের কোলকাতার ফ্লুরিস এর কথা মনে করিয়ে দেয়। অতি সুস্বাদু সব স্যান্ডুইচ, প্যাটি আর কেক দিয়ে ডিনার সারলাম । রাতে হোটেলে ফিরে পরদিন যাবার তোড়জোড় শুরু হল।


১০ই জুন স্নান ও প্রাতরাশ সেরে থিম্ফুর ফুন্টশোপেলরি হোটেলকে বিদায় জানিয়ে, পুনাখা ও ওয়াংডু শহরের পাস হাতে নিয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা রওনা দিলাম পুনাখার পথে। এতক্ষণ একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি, আমাদের ভারতীয় সময়ের সাথে ভুটানের ব্যাবধান আধঘন্টার । ভুটান এগিয়ে আছে এই একটা বিষয়ে । পুনাখার পথে পড়ল দোছুলা পাস, বেশ সুন্দর রমনীয় স্থান এটি। আরা পড়ল ওয়াংডি চু , বাতা চু নদী । "চু" শব্দটির অর্থ হল জল । গাড়ি ততক্ষণে নীচে নামতে শুরু করেছে । নদীর ওপরে লম্বা লম্বা গাছের থেকে ঝুলছে সার সার রঙিন ধ্বজা বা পতাকা যার ওপরে পালি স্ক্রিপ্টে লেখা তিব্বতীদের ধর্মের বাণী । আকাশে , বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই সব ধর্মের অমোঘ কথা, শান্তির বাণী, আদার্শতার কথা, অহিংসার কথা ; নদীর জল, বাতাস সেই বাণীর ধারক ও বাহক ...এই তাদের বিশ্বাস ! লোবেসা নামক গ্রামে পৌঁছে আমরা লাঞ্চ সারলাম থুকপা এবং চিজ মোমো দিয়ে । এবার আবার চলার পালা । কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছালাম পুনাখাতে। পুনাখার কাছেই ওনাখা গ্রামে পুনাটাংচু নদীর ধারে মনোময় কটেজ ; আমাদের হোটেলের নাম জাংডো পেলরি । নদীটি বিশাল লম্বা । আমাদের বারান্দায় বসে নদী দেখা যায় । পুনাখায় ঠান্ডা খুব কম । দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে হেঁটে গেলাম নদীর ধারে। পাহাড়ের কোল আলো করে নদী অনর্গল বয়ে চলেছে নিজের খেয়ালে, গেয়ে চলেছে অবিরাম । স্বচ্ছ নদীর জলের ওপরে ছোট্ট ছোট্ট ঊর্মিমালারা কুঁচি দুলিয়ে নেচে চলেছে | সাদা বালির চর সাদা নুড়ি পাথরের সমাবেশ দেখে বুঝলাম বর্ষায় এই চর জলে থৈ থৈ করে। নদীর অতিশীতল জলে পা ডোবালাম । ভুটানে আসা পর্যন্ত চিকেনের সাথে আড়ি চলছে বলে রাহুল একটু মনমরা হয়েছিল কিন্তু নদীর জলে নামতে পেরে সে দুঃখটা ভুলে গেল ! রাতের খাওয়া সারলাম হোটেলে আজ টিপিক্যাল ভুটানিজ কুইজিন খেলাম । এসপারাগাস স্যুপ, এমা ডাটসি( লম্বা লম্বা কাঁচা লঙ্কা ও চিজ দিয়ে বানানো) , সামু ডাটসি (মাশ্রুম উইথ চিজ ) আর চাউমিন দিয়ে | পুনাখায় দিন বড় তাই সন্ধ্যে নামল রাত আটটায়। ডিনার খেয়ে এসে কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে নদীর ধারে, পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়ির সব আলো জ্বলা দেখে মনে হোল
"তোমার সবুজ অন্ধকারে জোনাক জ্বলে ঘরে ঘরে,
নদীর সুরে সুর মিলিয়ে আমি এলাম তোমার দ্বারে
পাহাড় তোমার মাদকতায়, নদীর স্রোতের উচ্ছলতায়
পেলাম তোমায় আবার আমি আপন করে নতুন করে"


১১ইজুন ভোরে কোনো তাড়া নেই । আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে বেরুলাম ন'টা নাগাদ । প্রথমে গেলাম নেচার পার্কে স্থানীয় একটি স্কুল সেটি মেনটেন করে । পো চু এবং মো চু নদীর কনফ্লুয়েন্সে (সঙ্গম স্থল) তৈরী বিশালাকার দুর্গ যার নাম পুনাখা জঙ। এই জঙ বা Dzongএর অর্থ হল দুর্গ । পুনাখা জঙ তৈরী হয়েছিল গুরু রিংপোচি র ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী । গুরুর কথা অনুযায়ী এই দুর্গটি তাঁর কাল্পনিক বসত বাটি জ্যাংটোপেলরির অনুকরণে তৈরী । জ্যাংটোপেলরির অর্থ হল copper clad mountain তাই সেই কথা মাথায রেখে বানানো ; স্থাপত্য শিল্পের এক অসাধারণ এবং অভাবনীয় রূপ দেখলাম এই দুর্গে। পো চু আর মো চু নদীর দোয়াবে অবস্থিত এই দুর্গে আছে ভুটান সরকারের অফিস, গুরু রিংপোচির সমাধি আর বুদ্ধের ৩৩ ফুট লম্বা একটি মূর্তি । ভুটানের রাজার তথা সরকারের দুটি সমান্তরাল ভূমিকা আছে। একদিকে তিনি দেশের রাষ্ট্র নেতা এবং দেশ সামলান ও অন্যদিকে তিনি সমগ্র দেশের ধর্মীয় গুরু ( যদিও এখন তিনি চেষ্টা করছেন ভ্যাটিকান মডেল ছেড়ে ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক মডেল দেশে আনার ) এই রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার দ্বিভাজন পরিষ্কার বোঝা গেল পুনাখা জং এ প্রবেশ করে । নদীর ওপোরে কাঠের সেতু পেরিয়ে জং এর প্রবেশ দ্বার । সেখান দিয়ে ঢুকে একধারে সারেসারে সরকারি অফিস অন্যধারে বিশাল বুদ্ধের মন্দির আর মধ্যিখানে গুরুর সমাধি ক্ষেত্র । দুর্গ তথা মন্দিরের রাজকীয় দরজা গুলি বহুধাতুর সমন্বয়ে নির্মিত এবং মন্দিরের দেযালে কাঠের ওপরে রংবেরংয়ের চিত্রকল্প অতীব দর্শনীয়। ফিরে এসে আবার গাড়ি করে গেলাম পোচু নদীর ওপর ভুটানের সবচেয়ে দীর্ঘতম হ্যাংগিং ব্রিজ যা ৬৫০ফুট লম্বা ও মাত্র ৫ফুট চওড়া । হাওয়ায় দুলে ব্রিজের ওপর হেঁটে এ মাথা থেকে ওমাথা গেলাম । রাহুল সাথে সাথে নদীতে পাথর ফেলে ও পাথর পতনের সময় মোবাইল ফোনের স্টপওয়াচে নোট করে নিউটোনিয়ান মেকানিক্সের সূত্র (1/2 gt2)ধরে জল থেকে ব্রিজের উচ্চতা মাপল নিমেষের মধ্যে ৩১ মিটার (আন্দাজ); নদীর ধার দিয়ে হেঁটে আসার পথে ঝোপের মধ্যে একধরণের পোকাদের সমবেত ঐক্যতান শুনে তাক লেগে গেল । ফেরার পথে পুনাখার বাজারে দাঁড়িয়ে ভাদিলাল আইসক্রিম খেলাম আমরা ।


১২ইজুন রোদঝলমলে পুনাখার পরিষ্কার আকাশ। সকালে উঠেই দেখি আগের রাতের বৃষ্টিবাদল গেছে টুটে। আগের দিন রাতেই হোটেলের কাঠের কটেজের চালে আমি বৃষ্টির টুপটাপ শুনতে পেয়েছিলাম । যাক বৃষ্টি যে আমাদের সঙ্গের সাথী হয়নি সেই রক্ষে ; নয়ত পাহাড়ে বৃষ্টি অতি মন্দ ব্যাপার একটা । সে অভিজ্ঞতা সিকিম যাবার সময় হয়েছিল। ভুটানে আমরা চিকেন বিরহে কাতর ছিলাম । নিষিদ্ধমাংস বিফ আর পোর্ক এর প্রতি দুর্বলতা আমাদের নেই । কিন্তু প্রচুর চিজ পাওয়া যায় এখানে । তাই চিজ এর প্রেমে পড়ে গেছিলাম । সকালে চিজ অমলেট আর টোষ্ট সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার বেরিয়ে পড়ার পালা । এবার যাত্রা আর একটা গ্রাম ওয়াংডির দিকে। সেখানে হোটেল বুক করা আছে । মিনিট পনেরো চলার পরেই প্রথম পিটস্টপ নেওয়া হল একটি জায়গায় যেখানে আমাদের ড্রাইভার বন্ধুটি পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।প্রায় দু কিলোমিটার হাইকিং করে পাহাড়ের মাথায় অতি জাগ্রত একটি বৌদ্ধমন্দিরে। বেশ নতুন অভিজ্ঞতা । বেশ খানিকটা ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে সরু সমতল রাস্তা ,তারপরেই চড়াই, আবার খানিকটা উতরাই এই ভাবে অনেকটা উঁচুতে উঠে মন্দির দর্শন হল। মা গাড়িতে বসে র‌ইলেন । পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে প্রচুর ধান চাষ হয় এই জায্গাটায় । আর নদীর জল আছে বলে জলের সমস্যাও নেই । রেড রাইস ভুটানের স্টেপল ফুড। তবে আমি হোটেলে খেয়ে কোনো তফাত করতে পারিনি আমাদের পরিচিত রাইসের থেকে কেবল রঙটা একটু লালচে । মন্দির দেখে এসে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে গাড়িতে ফিরে এলাম । আবার চলা শুরু । কিছুক্ষণের মধ্যেই পুনাটাংচু নদীর ধারে আমাদের ড্রাগন নেষ্ট হোটেলে এসে পৌঁছালাম। একদম নদীর ধারে হোটেল অসাধারণ নদীর ভিউ ,ঘরথেকে দেখা যায়। আর ওয়াংডি বড় বাতাসীয়া জায়গা। অতি মনোরম জলবায়ু ।
হাওয়ার গতি, মাতায় মতি,
পাহাড় ঘেরা, নদীর ঘোরা
নেইকো ঘরে ফেরার তাড়া
ফিফার সাথে চা-পকোড়া
আলসেমিতে ? নেইতো ক্ষতি !

Saturday, May 29, 2010

ঋণি

আবার তোকে চাইছি কিশোরবেলা,
নদীর ধারে ভাঙা পাড়ে সেই যে বকুলতলা
আমি তখন দশ-এগারো, শিউলিফুলের ভোর
আম-কাসুন্দী, লুকোচুরি, চোখে স্বপ্নের ঘোর
কাঠবেড়ালির পেয়ারা চুরি, ভাঙা কিছু কাঁচের চুড়ি
পেরিয়ে গেলি কিশোর সিঁড়ি, বসন্তে তোর দোলপিঁড়ি

আমি তখন ঊনিশ-কুড়ি, পুতুল বিয়ে ভোলা
কফিহাউস, অন্ত্যাক্ষরী আর, তর্কে তুফান তোলা
নিউমার্কেট, চৈত্রসেল, দু একটা টিউশানি
লাইব্রেরি, মেগাসিরিয়াল আর, “মহীনের ঘোড়া” শুনি
শীতের রোদে পিঠ তোর, উলকাঁটার উল্টোসোজা
সহজপাঠ শেষ হোলনা কো, শুরু রাস্তাখোঁজা

আবার তোক চাইছি কলেজবেলা
গানসিঁড়িটির ধার ঘেঁষে আয় আমার মেয়েবেলা
গানের ইস্কুল, বর্ষামঙ্গল ফিরিয়ে দেব তোকে,
মুঠো মুঠো শিউলি দেব,  কাঁচের চুড়ি পরিয়ে দেব
পয়লাবোশেখ, ফ্রকের ঝালর, জরির ফিতের ফাঁকে।

Wednesday, May 26, 2010

Saturday, May 15, 2010

"প্ল্যান-চ্যাট " (অণুগল্প)


রাতটা চব্বিশে বোশেখের আর সময়টা পোষ্টডিনার ।  সন্ধ্যেটা ছিল বৃষ্টিময়তায় মাখা, মনটা ছিল প্রাক-রবীন্দ্রজয়ন্তীর  আড্ডার মেজাজে । ঋক, ঋভু, ঋজু আর ঋতম এর হাতে তৈরী ব্যান্ডের বার্ষিক প্রোগ্রাম “ঋ এ রবি, রাতের তারা”..তারই জোর প্রস্তুতি | প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর, নতুন যৌবনের এই চারজন দূতের অনেক স্বপ্ন মনে আর স্বপ্ন নিয়েই এই চঞ্চলতা । গ্রুপচ্যাটে চারজনের প্রতিদিনের নেটালাপে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিকল্পনার রূপায়ণের প্রয়াস চলে। সেদিন ছিল প্রোগ্রামের আগের রাত । তাই উত্তেজনার পারদ হৈ হৈ করে উঠেছিল আর দুকুল-প্লাবি চারটি মন-নদীর চ্যাট-বক্স যেন উপছে পড়ছিল কথায়, কথায় আর কথায় …
ঋক : তাহলে ঋজু শুরু করছে আবৃত্তি দিয়ে “তোমারে নমি এ সকল ভুবন মাঝে ….”
ঋভু : এরপরে ঋক তোর গান “তুমি কি কেবলি ছবি, শুধু পটে লিখা….”
ঋজু : নেকস্ট ঋক, তোর নিজের কথায় আর সাথে গীতাঞ্জলি থেকে পাঠ …
ঋতম : এবার আবার ঋভুর সোলো গান  “শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়…”
ঋক : এবার আমাদের কোরাস “আজি শুভ দিনে পিতার ভবনে অমৃত সদনে চল যাই “  তাই তো রে?
ঋভু : হ্যাঁ, ঠিক আছে |এবারে সঞ্চয়িতা থেকে বনবাণীর  উদ্‌বোধন কবিতার অংশ,  আমার আর ঋজুর দ্বৈত আবৃত্তি “ডেকেছ আজি, এসেছি সাজি হে মোর লীলাগুরু —”
ঋভু : মানে  “নৃত্যলোল চরণতলে মুক্তি পায় ধরা, ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়ে ওঠে জরা”  পুরোটা তো ?
ঋতম : এবার আবার  আমাদের চারজনের কোরাস “আলোকের এই ঝরণাধারায় ধুইয়ে দাও ”
ঋক : @ ঋতম, ঠিক আছে, মিউজিসিয়ানদের পেমেন্ট গুলো নিয়ে যাস খামে ভরে
ঋভু : @ ঋক,  মাইক ওলা কে আবার বলে দিস, সময় মত পৌঁছে যেতে
ঋজু : @ ঋতম,  তুই তাহলে ফুল-মালা-মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হচ্ছিস কাল
ঋতম : তাহলে কাল বিকেল ৫টা, সবুজবীথি, চাষীর বাগান মাঠ

হঠাত্‌ পাবলিক চ্যাট রুমে আবির্ভাব এক অজ্ঞাতকুলশীল পঞ্চম অতিথির । ইথার তরঙ্গের বাতাস যেন ভারি হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে । নিবে গেল ঘরের আলো, শুধু জ্বলতে লাগল ল্যাপটপের আলো…..
গেষ্ট : তোমাদের  কিসের এত তোড়জোড় চলছে?
ঋক : আমাদের আগামীকাল রবিঠাকুরের সার্ধশতবর্ষ জন্মজয়ন্তীর একটা প্রোগ্রামের ব্যাপারে কথা হচ্ছে।
গেষ্ট: তোমরা এই সাইবার এজের তরুণেরা এখনও রবীন্দ্র চর্চা কর বুঝি?
ঋভু : মানে? রবীন্দ্রনাথ আমাদের শয়নে, স্বপনে, জাগরণে…
গেষ্ট : তার মানে তোমরা এখনো পড়?”তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে”
ঋক : কেন ? আপত্তি কোথায়?
গেষ্ট : তোমরা সহজ পাঠ পড়েছ?
ঋতম : না পড়ে আজ রবীন্দ্রনাথ বলে চেঁচাচ্ছি বুঝি?
গেষ্ট : তোমরা  কেমন রবীন্দ্রনাথ পড় । আমাদের সময় আমরা পেয়েছি কালিদাসকে, আর পড়েছি বিদেশী সাহিত্য।
আচ্ছা তোমাদের কি মনে হয়না যে এই রবীন্দ্রনাথের জন্য কত শিল্পী আজ করে খাচ্ছে।
ঋতম : হ্যাঁ, ঠিক ই তো |
গেষ্ট : কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান, আবৃত্তি, নাটক এ নিয়ে তো দেশের সক্কলে কবিপ্রণাম জানাচ্ছে তা তোমরা কিছু নতুন জিনিষ ভাবছ না কেন?
গেষ্ট : পদার্থবিদেরা নিউটোনিয়ান মেকানিক্স বা যাকে তোমরা ক্লাসিকাল মেকানিক্স বল, তা থেকে এগিয়ে গিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে কোলাকুলি করছে, সেখানে তোমাদের মত শিল্পীরা সেই রবীন্দ্রজয়ন্তীতে পড়ে রয়েছ?
ঋক :  না, মানে ঠিক তা নয়  …
গেষ্ট :  ছড়িয়ে দাও রবীন্দ্র ভাবনা ইন্টারনেটে, শুনছিলাম জেমস ক্যামেরন বলে একজন “অবতার” নামে একটি ছবি করেছেন|
তা তোমরা  মাল্টিমিডিয়ায় পাল তুলে দাও না রবীন্দ্র স্মরণ-মননের ! “তাসের দেশ” পড়েছ নিশ্চয়ই , তা মাথায় আসেনা? তাসের দেশকে কেমন করে ত্রিমাত্রিক ভাবে বানানো যায় ? আজ দেড়শ বছর ধরে সেই গতানুগতিক রবীন্দ্রজয়ন্তী দেখে আসছি । তা তোমরা বাপু পরের বছরে এই তাসেরদেশ নৃত্যনাট্যটিকে যদি মাল্টিমিডিয়ার সাহায্যে মঞ্চস্থ করতে পার তাহলে বুঝি | যেখানে তাসের দেশের বিচিত্র তাসেরা মানুষের চারপাশে নেচে কুঁদে সব অনুশাসনের কথা বলবে, আর দর্শকরা ৩ডি চশমা পরে  দেখবে আর চেঁচিয়ে বলে উঠবে “এলেম নতুন দেশে …..” অথবা গেয়ে উঠবে “আমরা নূতন যৌবনেরই দূত”

ঋক : খাসা চিন্তা ভাবনা ! আপনার ক্রিয়েটিভিটির তারিফ না করে পারছিনা ।
গেষ্ট : রিসোর্স কে ভাঙিয়ে খাচ্ছ খাও  কিন্তু মনে রেখ, রিসোর্সের আর লিমিটেড বাট ক্রিয়েটিভিটি ইজ আনলিমিটেড !
ঋভু : এক্কেবারে ঠিক কথা বলেছেন । আপনার ইমেল আইডি টা দেবেন প্লিজ, আপনি আসুন না আমাদের অনুষ্ঠানে
গেষ্ট :  “তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয় ”
ঋজু :  দিন না আপনার ব্লগের ঠিকানা
গেষ্ট :    ইমেল :  bhanudada@parolok.com
আর  ব্লগের ঠিকানা  : http://rabindranath.geetanjali.com


“তোমাদের   “ঋ এ রবি রাতের তারা”
উঠুক ফুটে  আকাশপারে
আমি আছি, ছিলাম সাথে
যুগযুগান্ত  বছর পরে”

হঠাত সকলের নেট কানেক্সন চলে গেল, কিন্তু ঘরের আলো জ্বলে উঠল দপ্‌ করে !


এই অণুগল্পটি  আরো দুটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে : কফিহাউসের আড্ডা এবং লোটাকম্বল

Sunday, May 9, 2010

রবি পক্ষে-কবি প্রণাম


                              (সত্যজিত রায়ের আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কেচ )

সীমার মাঝে অসীম তুমি আমাদের এক রবি
তোমার গানে তুমি হ'লে সুরলোকের কবি ।
তোমার তুলির টানে তুমি আঁকলে ছন্দে ছবি
তোমার সুরে, অগ্নিবীণায় মূর্ত হ'ল রবি ।
আজি এ প্রভাতে রবির কিরণে,
প্রণমি তোমারে এই শুভ দিনে।
বেল জুঁই রজনীগন্ধায় ঢাকা তোমার মুখ !
কি প্রশান্তি দু'আঁখিতে তব, দেখি হয়ে উন্মুখ !
আজ তুমি নেই সাথে, বাণী রেখে গেছ পথে আমাদেরই তরে,
আজি শুভ দিনে, আমরা হাজির তোমায় প্রণাম করে।
পটেলিখা ছবি তুমি চির সমাদৃত আজ |
রূপে-রসে-রঙে টলোমলো, গোলাপের মতো সাজ!
শুনি তব পদক্ষেপ নির্জন সৈকত উপকূলে বসি,
এসেছিলে ধরাধামে কোন এক নক্ষত্র খসি |
ধন্য জীবন তোমার ধন্য ইহলোক,
সুরের ঝর্ণাধারায় প্লাবিত তোমার আলোক।
দিবস রজনী সাহিত্যের মহা আনন্দ ভোজ,
পঙতি ভোজনে আপ্যায়িত মোরা চেটেপুটে খাই রোজ |


শৈশবে মেঘের কোলে রোদের খেলায় বাদল যখন টুটি
ছোট্ট আমি নাচের তালে তারা হ'য়ে যেন ফুটি।
কৈশোরে তুমি সুরের গুরু দাও গো সুরে দীক্ষা,
তোমার গানে তোমার ছন্দে শুরু সংগীত শিক্ষা।
যৌবনে তুমি প্রেমের কবি আমার পরাণ যাহা চায়,
সে ছাড়া মোর কেহ নাহি আর আছে যেন এ ধরায়।
বিয়ের পরে অবগুন্ঠন খুলি, ভালোবাসি ভালোবাসি,
যাকে পেলাম তাকে নিয়ে তোমার সুরে বাজাই বাঁশি।
প্রৌঢ়ে আমার, তোমার সাথে বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে,
তোমার সুরে গানের ভেলায় ছন্দের দোলাতে।
বার্ধক্যের বারাণসীতে দেখি কি বিপুল তরঙ্গ!
উদ্বেলিত গগনে মোর পাখা ঢাকে বিহঙ্গ ।
আমার প্রাণে জাগালে তুমি সুরছন্দের দোলা
গানে কাব্যে মন ভরিয়ে সারাদিন করি খেলা।


আজ এ প্রভাতে শুভ ২৫শে বৈশাখ
পুনর্জন্ম হোক তোমার এই মোর অভিলাষ।
তোমার মন্দিরে আরতি করি
তুমি ফিরে এস নব রূপ ধরি।
বিকশিত কর অন্তর মম তোমারই নতুন গানে
বন্দিত হোক চরণ তোমার আমারই পুষ্পস্নানে।
নতুন নতুন গল্পগুচ্ছে কথা কাহিনীর সৃষ্টিতে
স্নাত হোক ধরা তোমার মুক্ত ঝর্ণাধারার বৃষ্টিতে

Saturday, May 8, 2010

Thursday, April 22, 2010

খোলাচিঠি — মাকে

 আজ আমার মায়ের জন্মদিন!  তাই মায়ের জন্য আমার লেখা এই কবিতাটি দিলাম। আমার ব্লগার  বন্ধুরা এবং পাঠকরা পড়লে খুশি হব। 

"খোলাচিঠি — মাকে "

“মা” তোমাকে দুদিন দেখিনি, মনে হচ্ছে দু’যুগ
এলোমেলো কিছু কাজের পাহাড় আমার সকাল
ঊনিশ-কুড়ির মত গুগুল দ্বীপে কাটে দুপুর |
বিকেলগুলো এখন “নয়নতারা”য় ফোটা,
খুব রঙীন না হলেও ছন্দ মধুর ;
দেখো মা, কত লক্ষ্মী হয়েছি আমি,
সিঁড়িভাঙার অঙ্কখাতায় আর কানমোলায়
ইতিহাস-ভূগোলের অগোছালোতায় আর নেই আমি।
চালডালের ফুটন্ত খিচুড়ির টগবগতায়,
থোড়-বড়ি-ডাঁটার জঞ্জালে আমার কলম চলছে
শেষপাতে পরমান্নের মত!
তোমার জুঁইগাছে জল, গীতা-গায়ত্রি-গঙ্গা,
তুলসীতলায় সাঁঝবাতি সব‌ই বাধ্যতার তালিকায়,
ধোপা-নাপিতের হিসেবের রোজনামচায়|
গরমের ছুটির খুনসুটির দুপুরগুলো, 

আমায় অঙ্ক কষায় আর ছবি আঁকায় ;
আমার অঙ্ক এখনো মেলেনি মা…
রোয়াকের রাইবেলের গন্ধ, বৃষ্টিবাদল-আড্ডায়, 

বর্ষামেঘের কাজরী গান শোনায় |

ফুলতলায় ঘর বেঁধেছিলাম আমরা…
শিউলিফোটার গন্ধবৃষ্টি পাবো বলে,
লক্ষ্মীপূর্ণিমার কোজাগর রাতের আকাশের 

সেই বাঁধভাঙা হাসি মনে পড়ে?
কার্ত্তিকমাসের আকাশপ্রদীপ দেখে মনটা ডুকরে ওঠে
দুরের তারার পানে চেয়ে ভাবি তোমার গানের কথা
বসন্ত দূরে, তবুও কোকিলটা জ্বালিয়ে মারে..
মন ভালো করা এসএমএস গুলো নিয়ে
মিসডকল গুলো দেখে বাঁচতে চেয়েছিলাম
আমি চলতে চলতে অন্ত:সলিলা ফল্গুনদী
রিক্ত হতে হতে শূন্যতায় পৌঁচেছি,
তবুও মুক্তি মেলেনি।
ভুলবোঝাবুঝির টানাপোড়েনে স্মৃতির ক্যানভাসকে
নতুন রঙতুলির টানে জিইয়ে রাখছি
সেদিনের গোধূলির গোগ্রাসে আমার ডুরে শাড়ির লালটুকু
আমার সীমন্তে লেগেছিল, হয়েছিলাম সুমঙ্গলীবধু !
আজও শুনতে পাই অতীতের কোলাহল
সম্বোধনের প্রতিধ্বনি, সম্মোহনের গান ।
আমি নীল পাহাড়ের কোলে একটা সাদা শহরে
শুনতে পাই সেই সব অকিঞ্চনের ছন্দ,
ছন্দপতনের শব্দ আর শুনি শব্দবন্ধনের হাতছানি।
সেই গুগুলদ্বীপের আমি এক নির্বাসিত অতিথি,
তবুও এই বেশ ভালো, আমার সব পেয়েছির দেশ !
পাগলের মত ধরেছি তাকে, শান্তিসাগরে ঘর বেঁধেছি
পিঠটা দেয়ালে ঠেকার আগেই ধরে ফেলেছি তাকে
তবুও বেঁচে র‌ইলাম আমার কবিতার অমরাবতীতে!





"খোলা চিঠি-মাকে" কবিতাটি আসামের করিমগঞ্জের দৈনিক পত্রিকা "দৈনিক জনকন্ঠ"র রবিবারের পাতা "জনমজলিশে" প্রকাশিত হয়েছে ২৫ শে এপ্রিল ২০১০

Monday, April 19, 2010

ছ'নম্বর পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয়

ছ'নম্বর পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।    
মনে পড়ে যায়...
দুপুরবেলার নিঝুম স্মৃতি
শান্ত পায়ে পথের চলা 
ক্লান্ত গায়ে কথা বলা 
রাজাবাজার কলেজ পারে  
ট্রামলাইনকে ক্রস করে  
এপিসি রোড ছুঁতো শেষে
ছ'নম্বর পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয় । 
আমরা তখন স্নাতোকোত্তর..
আমরা খোলা হাওয়া
স্বপ্ন নেশা চোখে মেখে
রঙীন হয়ে যাওয়া  
খগেনদাদার  চায়ের  ঠেকে,
ল্যাবের সেই কোণার মাঝে
মিনিট পাঁচেক জিরেন হত
টেস্টটিউব টা হাতে নিয়ে
ছ'নম্বর পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।
সুলগ্নার বাসের প্রেমিক,
কমলিকার দেখতে আসা,
সুদীপের স্বপ্ন দেখা
বিদেশ যাবার কত আশা !
অমৃতা আর সুমন জুটি
পাশাপাশি থাকত কেবল
গোপন প্রেমের কেমিস্ট্রিতে
গসিপ গিলি সবাই তখন
সূয্যি ডোবে আঁধার নেমে আসে
ছ'নম্বর পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।
ফার্স্ট ইয়ারেই ভিসা পেল
সুমন-অনীক-জয়দীপরা
হলনা কো অমৃতার 
সুমনের সাথে বাড়ি ফেরা 
র‌ইলো পথের ধূলোগুলো   
উড়ে গেল কিছু
র‌ইলে নীরব প্রেমের তুমি
সাক্ষী হয়ে শুধু
ছ'নম্বর পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।
আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ার
একশো কুড়ি জন 
কফিহাউস, ব‌ইপাড়া, জটিল সমীকরণ 
উতল হাওয়ায় উড়ে গেল
টেষ্টটিউবের রঙীন জলে
না বলা কথারা র‌ইল পড়ে
কফিহাউসের সাদা টেবিল লিনেনে
র‌ইল  ছোঁয়া  সাতাশি সালের ব্যাচ
র‌ইলে তুমি পড়ে
ছ'নম্বর পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।  

Wednesday, April 14, 2010

"সোনার তরী" র সকল পাঠকবন্ধুকে জানাই নববর্ষের অভিনন্দন !!

 শুভ ১৪১৭
এসো বোশেখ, বস ! তুমি বাজাও আমি শুনি
এসো বোশেখ, বস ! তুমি দাও আমি গুনি
পারলে দিও বৃষ্টির বর্ণমালা  একমুঠো
একটা কি দুটো কালবোশেখি,
পারলে  নিও আমার তাপের ভার
তবুও তুমি না এলে হয়ত পূর্ণ হবেনা একরাশ আশা,
এক ভর্তি জলভরা মেঘেদের ভেলায় চড়ে ভাসা.. 
সেদিন যেমন এসেছিলে তুমি 
কালবোশেখির কোলে চেপে, 
মধ্যদিনে আঁধার করে  
ঠান্ডা হাওয়া জাপটে ধরে.... 
এসো তুমি বোসো তুমি  ! 
কাল বিকেলে চৈত্রের আগুণ সূর্যের ভাসান
গঙ্গাতীরে, সে কি আলো!  
একটু বাদেই মনে পড়ে গেল
আজ তোমার আসার কথা   
চৈত্রের বিদায়বেলায় সেই খেয়া চলে গেল দূরে, বহুদূরে ..
রেখে গেল সেই সারি গান, ভাটিয়ালির ঝিমধরা নেশা, 
আবার স্বপ্ন জাল বোনা শুরু হবে 
জ্বলে উঠবে কত আশার রং দেশলাই  
কত নিরাশার ফুলঝুরিরা ছিটকে সরে যাবে দূরে, অনেক দূরে ..
মেঘের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসবে একরাশ হাসি,  
এক মুঠো রোদের কণা ঝরে পড়বে প্রথম সকালে 
আর টুপটাপ ঝরে পড়বে জলের কণারা  বিকেলমেঘ থেকে


Sunday, April 4, 2010

ছুটি

১৯১৪ সালে পূজোর ছুটির পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গয়া থেকে বেলা যাবার পথে রেলওয়ে ওয়েটিংরুমে বসে লিখলেন পথের গান


"পান্থ তুমি পান্থজনের সখা হে,
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া
যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
তারি কন্ঠে তোমারি গান গাওয়া"

জানি বিদায়ী ফাগুণের গায়ে এখন চোখঝলসানো চৈতী আগুণ কিন্তু ছুটির অমোঘ আকর্ষণ আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গুডফ্রাইডের ভোরে খড়গপুর থেকে বোলপুরের পথে... "তোমায় নতুন করে পাবো বলে" |    দেখা হয়েচে বহুবার চোখ মেলে, তবুও ঘর থেকে দুপা ফেলেই আবার হাঁটি চেনা পথে, আবার নতুন করে আবিষ্কার করি গ্রামবাংলাকে।পথের আকর্ষণে বেরিয়ে পড়ি বারবার, কালের গাড়ি আরোহন করে। লিখে চলি পথের পাঁচালী । ভোর ৬টায় শুরু করি যাত্রা, সঙ্গে একথার্মোস চা, কিছু কুকিস, মাফিন  আর কয়েকটা কচি শশা নিয়ে ।




ন্যাশানাল হাইওয়ে ৬০ ধরে পূবের আলোয় পশ্চিম মেদিনীপুরের পথে, শহর মেদিনীপুরকে পাশ কাটিয়ে জঙ্গলমহলের রাস্তা ধরে । একে একে পড়ল সারি সারি শালগাছ অধ্যূষিত গোদাপিয়াশাল, শালবনী, গড়বেতা ইত্যাদি  গ্রামগুলি, পেরোলাম কংসাবতী আর শীলাবতী নদী । শুনেছি মাওবাদীদের জায়গা এই জঙ্গলমহল ।  সকালের মিষ্টিরোদ এসে পড়েছিল তখন শালবনের মাথায়, বসন্তের কচি সবুজপাতায় । চেনাপথ যেন আরো নবীন সজীবতায় ভরে উঠছিল । 




গড়বেতা পার হয়ে বিষ্ণুপুরের পথে পা বাড়ালাম । এই রাস্তা নাকি  হাতি পার হবার করিডোর  ...বালুচরীর জন্মস্থান, টেরাকোটার ঘোড়ার দেশ, গ্রামবাংলার চালার অনুকরণে তৈরী অত্যন্ত সুন্দর সব  মন্দিরের হাট এই বিষ্ণুপুরে। কত নাম না জানা মন্দির যত্রতত্র বিরাজমান ;  পোড়ামাটির নিখুঁত  স্থাপত্য মন্দিরের গায়ে এখনো শোভা পাচ্ছে । এইখানে হাতি দেখা কাপালে থাকতে হয় ; যাই হোক ভয়ে ভয়ে আমরা নিলাম প্রথম হল্ট,  ধূমায়িত চা আর মাফিন দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। আবার শুরু পথচলা। এবার বাঁকুড়ার রাস্তা ধরে কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেট হাইওয়ে ৯ ধরে বড়জোড়ার পথে.. আবার পেরোলাম শাল-ইউক্যালিপটাসের বন, হাতি পার হওয়ার করিডোর । শুনেছি বরজোড়ার "মন্ডা"  নাকি একটি বিখ্যাত মিষ্টি তবে এখন অনেক নকল বেরিয়েছে তাই সে পথে পা বাড়ালাম না । কিংবদন্তীর আড়ালে লুকিয়ে আছে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন তৈরী হবার সময়কার চিতাবাঘের গল্প।   এখন সেখানে শুধু মেজিয়া পাওয়ার প্ল্যান্টের  ধূসর  ফ্লাই-এশ বহনকারী ট্রাকের সারি। নগরায়ন তথা বিশ্বায়ন তো দূরের কথা এখন শিল্পায়নে ব্রতী হয়ে আমরা  "অরণ্যমেধ"  যজ্ঞে সামিল হয়েছি।


পর্যাপ্ত  ধূসর উড়ন্ত ছাইকে সবুজ পথের সাথী করে আমরা পেরোলাম  দ্বারকেশ্বর আর গন্ধেশ্বরী নদীর সেতু।এই দ্বারকেশ্বর নদী সাহিত্যের পাতায় জনপ্রিয়  বিদ্যাসাগরের জন্য । মায়ের কাছে পৌঁছেছিলেন রাতারাতি দ্বারকেশ্বর সাঁতরে বাঁকুড়া থেকে মেদিনীপুর । বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি চিরস্মরনীয় ।  সেই কারণে দ্বারকেশ্বর পেরোতেই স্মরণ করলাম তাঁকে।
এরপর  গোল্ডেন কোয়াড্রি ল্যাটারালের কোলকাতা-দিল্লী শাখায়  ওরফে শেরশাহ সুরীর তৈরী গ্র্যান্ড- ট্রাঙ্ক-রোডে  পড়ে  পানাগড় অবধি গিয়ে মোরগ্রাম হাইওয়ের বাঁকে ঘুরে  ইলামবাজারের জঙ্গলে গিয়ে পড়লাম। মধ্যে পেরোলাম অজয় নদী। তারপরেই কবিগুরুর কর্মভূমিতে,  ছাতিম, শিমূল, পলাশের শহর শান্তিনিকেতনে।  বসন্ত নেই এখন আছে চৈতীর চোখ ঝলসানি রোদ আর রাতে একটু ঠান্ডা হাওয়া ।শ্র্রীনিকেতন, বিশ্বভারতীর আশ্রম পেরিয়ে বনপুলক, শ্যামবাটি, তালতোড়কে  সরিয়ে রেখে আমরা দুপুর সূর্যকে মাথার ওপরে রেখে পৌঁছলাম  প্রান্তিক। আমাদের "সোনারতরী" ফেজ ১, আবাসনের ক্ষুদ্র বাগান বাড়ি যার নাম "কৃষ্ণকলি" । রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ভাবতে পারিনা এখানকার কোনোকিছুকেই তাই বাড়ির নাম করণেও রাবিন্দ্রীক হয়ে পড়েছিলাম।


বাড়ির পাশেই ক্যানালের জল বয়ে চলেছে । যদিও ভরাবর্ষায় এই জলের অমোঘ আকর্ষণ আমাকে আরো টানে। সোনাঝুরির ছায়ায় প্রান্তিকের বনবীথি যেন ঘুরে ফিরে নতুন করে ধরা দেয় আমার কাছে। অনতিদূরে কংকালিতলায় মাকালীর মন্দিরের আকর্ষণও দুর্নিবার ।  ৫ সতীপিঠের একটি এটি; দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর খন্ড দেহাংশের কাঁখাল অর্থাত কোমরের অংশ বিশেষ পতিত হয় এখানে ...একটি কুন্ডে। আর পাশে উত্তরমুখে প্রবাহিনী কোপাই নদী সংলগ্ন এলাকায় শ্শ্মশান । আমি এই জায়গায় এলে কিছু মাহাত্ম্য অনুভব করি।  


প্রতি শনিবারে খোয়াইয়ের পথে হাট বসে । এটি ও আর কোথাও দেখিনি। সূর্যাস্তের ঠিক ঘন্টা দুয়েক আগে থেকে বসে এই হাট। কত শিল্পীরা নিজ নিজ শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেন সেখানে আর সাথে থাকে বাউলের গান । রাঙামাটির পথ ধরে আমরাও পৌঁছে যাই সেখানে । ডোকরার গয়না, কত রকম ফলের বীজ দিয়ে তৈরী গয়না, কাঁথার কাজের বাহার, পটশিল্প,  বাউলগানের আনুষাঙ্গিক বাদ্যযন্ত্র, তালপাতা, পোড়ামাটির কাজ, বাটিকের কাজ আরো কত কিছু এনে তারা বিক্রি করে । কিন্তু অন্ধকার হবার পূর্বমূহুর্তেই পাততাড়ি গোটাতে হয় তাদের ।  


এই নিয়ে আমাদের ২৪ বার যাওয়া হোল শান্তিনিকেতন । তবুও সে পুরোণো হয় না। আমি কিন্তু কোলকাতার হুজুগের  আম জনতার মত পৌষমেলায় কিম্বা বসন্ত উত্‌সবে আসি না এখানে । কারণ ভীড় আমার ভালো লাগেনা । দু একবার দেখেছি পৌষমেলা, গেছি বসন্ত উত্‌সবে । কিন্তু আমাদের চিরসখা "নিরালা" কে তখন পাইনা,  কাব্যের উঠোনে হোঁচট খেতে হয়,  ব্লগের আঙিনায়  নতুন পোষ্টের জন্য কল্পলোকের ইশারা থাকেনা । এখানে আসি লিখতে, ভাবতে, লেবু ফুলের গন্ধ নিতে, পলাশের একটুকু লালকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে আর সর্বোপরি মাস তিনেকের বাঁচার রসদ আর শ্বাসবায়ু নিতে।  আমার ছোট্টবাগানের ফুলেদের সাথে কথা বলে আসি । পাখিদের সাথে গান গেয়ে যাই ।  আর খবর নিয়ে যাই কৃষ্ণকলির, তাকে ভালো থাকতে বলি,  সবুজে আর নীলে মিশে সুন্দর থাকতে বলি ।

Monday, March 29, 2010

সহেলী-সমালি-সমাচার


সহেলী:                                                      
শহরের প্রাণকেন্দ্রে, তিনতারা হোটেলে,
আলো-আঁধারের ডিস্কোথেকে, 
এসে শোনাই গান রঙিন পোশাকে, 
আজও এসেছি..
কিন্তু কোনোদিন এমন হয়না,
ভুলে থাকি গানে,
লাস্যময়ি হাস্যময়ী শ্রীময়ী রূপে...
আমি এখন মিস্‌ সহেলী, নিইনা পদবী, 
জানি না তোর নাম আমি,
কৃষ্ণা, কেয়া কিম্বা করবী। 
কিন্তু কোথায় যেন দেখেছি তোকে?
শুধাই নিজের মনে নিজেকে..
সমালী:
কেন খালি চেয়ে থাকো?
কলেজে পড়ি সেকেন্ড ইয়ার,
নাচতে পারিনাকো!
তোমার গলা চেনা নয়,
তবু গায়ের গন্ধ কেন চেনা মনে হয়!
সহেলী:
আজ কেন আমার নাচের তাল কেটে যায়... 
বারবার কেন স্বররূদ্ধ হয়ে যায়,
চেনাগানের কলিও অকারণে হরিয়ে যায় অবচেতনে
আমি খালি চেয়ে র‌ই তোর মুখপানে...
কি নাম তোমার? থাকোই বা কোথায়?
আছো কেন একা বসে এই সন্ধ্যায়?
সমালী:
আমি সমালী, মায়ের দেওয়া নাম কমলিকা,
বন্ধুরা আসবে এখুনি, ততক্ষণ বসে একা, 
জন্মদিন আমার আজ ..
তুমি কি গান গেয়ে মাতাবে আজকের সাঁঝ?
সহেলী:
সোমত্ত মেয়ে তুমি একা কেন এলে? 
সন্ধ্যাবেলা শহরের এই হোটেলে...
সমালী:
আমি তো অনাহুতা, রবাহুতা, অবাঞ্ছিতার দলে 
বাঁচিয়ে রাখার ঋণে আমি চিরঋণি গৌতমীমার কাছে,
নিয়েছে কোলে তুলে অভগিনী এই শকুন্তলাকে, 
তবুও পাইনি সুখের খোঁজ, দেখিনি সৌভাগ্যের মুখ! 
ছিল যে জন্মলগনে আস্তাকুঁড়ের  অভিশাপ!
সহেলী:
কেন তুমি দাও না ধরা মোরে,
কেন রাখো? না বলা কথা বুকের মাঝে ধরে ?
সমালী:
বাবার ব্যবসা জানি, তবে মা যে নয় নিজের আমার,
পাড়ার লোক বলে তাই ;
কোনো এক শীতের ভোরে, বাবা এনেছিল আমায় বাড়ি,
চট জড়ানো ন্যাকড়া গায়ে, ঠিক যেমন করে পড়ে থাকে
নেংটি ইঁদুর, কুকুর ছানা অবহেলায় পথের ধারে...
গাড়ি চেপে এলো বাড়ি, এলো সেই মেয়ে,
ফুটলো কমল কপাল জোরে,
কমলিকা নাম দিল সে, 
বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে, যত্নে, সুখে মানুষ করে...
স্কুল পাঠিয়ে বড় করে,
কিন্তু কেন জানি কৃত্তিমতার স্পর্শ অনুভূত হয় সেই বাত্‌সল্যে? 
কেন জানি সম্পর্কের গভীরতায় প্রবেশ করতে পারিনা..
তোমায় কেন এত কথা বলে নষ্ট করি তোমার সময়,
চেনা চেনা মুখ, ডাকে কাছে আয়..
বলো না কে তুমি?
বন্ধুরা এসে পড়লো বলে...
সহেলী:
আজ আর গাইব না গান আমি,
তোর ডান গালের ঐ কালো জড়ুল,
বুঝিয়েছে মা তুই যে আমার,
আমার প্রাণের প্রথম প্রেমের তুই যে ফসল,
যৌবনের‌ই রঙিন জলে, ভেসেছিলেম দুজন মিলে,
ভাবিনি যে ফিরে পাবো, আবার দেব ভুলের মাশুল ! 
সমালী:
বেশ তো, তবে চলো আমার সাথে,
ভুলের মাশুল দিয়োখনে সেথায় আজ রাতে,
সহেলী:
না সে হয়না সমালী, না কমলিকা,
কেউ মানবে না আজ আমার কথা আমি যে আজ একা !
কেনই বা করবি ক্ষমা ?
পারেনি যে মা দিতে তোরে কোল একদিন,
বাধেনি তার একটুকুও ছুঁড়ে ফেলে দিতে,
সেই কঠিন পথের ধূলার পরে,
নরম শিশুর কান্না ঝরে!
সমালী:
যদি আমি বলি তাদের, যদি আমি সাক্ষী দিই, 
মায়ের সেই মেয়ে হয়ে যদি পরিচয় দি‌ই,
যদি একবার ডাকি মা বলে..
ভুলে যাই সব, ভুলে যাও সব,
বাঁচি মোরা দুজনে আবার নতুন করে । 

"সহেলী-সমালী-সমাচার"  এই কাব্যনাট্যটি তিনসুকিয়া কলেজ অসম থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা "প্রজ্ঞান" ২০১০ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে

Tuesday, March 9, 2010

"আজও বেঁচে আছি রে"

তোর মন ভালকরা এস.এম.এস
আমার অক্সিজেন,
তোর মিসডকল আমার ওয়েসিস
তোর হাতের ওপর হাত রেখে
আজও শুনতে পাই কত কান্না ছিল
একসময় তোর বুকে...
তোর মায়ের ক্যানসারের যন্ত্রণা
তোর ভায়ের কম্পার্টমেন্টাল
তোর বাবার শেয়ার মার্কেটের লস
তোর দজ্জাল শ্বশুরবাড়ির ষড়যন্ত্র,
আয় তুই বল আমার কাছে, 
আমিও আজ তোর মত ইনসমনিয়ায়
বন্ধুত্ব আজ কুইনাইন
ঝর্ণাকলমের কালি বন্ধ্যা কাগজে 
কবিতার ভ্রূণ সঞ্চার করতে আজ অক্ষম 
দ‌ইবেচার কত সুখ অমল বোঝেনি সেদিন
আমি কিন্তু বুঝেছি,
কফিহাউসের অমলের মত
কত অপ্রকাশিত কবিতারা
আজও আমার গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে 
কিন্তু আজও বেঁচে আছি রে  

Saturday, February 27, 2010

WISHING YOU ALL A VERY "HAPPY HOLI"


বসন্ত মানেই কৃষ্ণচূড়া , পলাশ, শিমূল ও অশোকের রেঙে ওঠা প্রকৃতি। বসন্ত মানেই সেই আগুণে মেতে ওঠা, দখিনা বাতাসের উড়নী গায়ে জড়িয়ে আবীরে মাখামাখি, বসন্ত মানেই মনের দোলা, ফাগুনের সকালে দোল খেলার পালা। আজ আমাদের দোল একটু ভিন্ন স্বাদের । একালের দোল আর সেকালের দোলে আকাশ্-পাতাল তফাত। আজ আমাদের দোলে পাড়ার কচি-কাঁচারা দোল খেলেনা,বরংএকটু ছুটির আমেজে দেরি কোরে ঘুম থেকে উঠে হোমওয়ার্ক করার প্রস্তুতি নে য়। কারন এখনকার দোলে সব স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলতে থাকে। তাই তাদের কোন উপায় থাকে না। ছোট বেলায় বাড়ীতে সত্যনারায়্ণ পূজো হতে দেখেছি। ভোর থেকেই পূজোর গোছগাছ, স্নান সেরে ফাঁকে ফাঁকে একেওকে আবীর দেয়া, গুরুজনদের পায়ে আবীর দেয়া ও গৃহদেবতার ছবিতে আবীর দিয়ে প্রণাম করা ..

কিন্ত কোথায় আজ আমাদের দোল? আমদের দোলে আজ ফুট্-কড়াই-মুড়কি-মঠ এর স্থান নেই; ছেলেরা বাজারে গিয়ে রঙীন মঠ কেনার বায়না করে না। বরং এগরোল, বার্গার বা পিত্জা চায়।

আজ আমাদের দোলে সান্ধ্য অধিবেশনে ফাগফাগুয়ার খেলা চলার পর সাদা পাথরের গ্লাসে সিদ্ধির সরবতের বদলে স্থান করে নিয়েছে সুদৃশ্য কাট্-গ্লাসের সুরাপাত্রের রেড্-ওয়াইন। আমাদের প্রজন্ম দোলের মাহাত্ম্য বোঝে কিনা জানিনা তবে বিশ্বায়নের আবীর গায়ে মেখে কেবল্ টিভি , মোবাইল ফোন্, আইপড্, এফ্-এম রেডিও এবং যন্ত্রজালে  প্রচুর গবেষ
ণা চালিয়ে যচ্ছে।

এখন আবীরের রং এর বিভিন্নতা ও প্লাস্টিক পিচকারির বৈচিত্র্য দেখে ছোটোবেলার জন্য মন কেমন করে কিন্ত আমাদের রং এ ছিল আরো উজ্জ্বলতা ও গন্ধে ছিল আরো মাদকতা।

আমরা ছোট ছোট নিউক্লিয়ার পরিবারের সদস্য, দোল উপভোগ করবই বা কার সংগে ? র্ংই বা দেব কার গায়ে? আমার গায়ে রং দেবে এমন সময়ই বা আছে কার্? র্ং খেলে সময় নষ্ট না করে কিশোররা এখন নেট সার্ফিং করে, "সোশাল নেটওয়ার্কিং" সাইটে ঢুকে র্ং খেলে, বন্ধুকে ই-গ্রিটিংস পাঠায় দোলের জন্য ; বা এস্-এম্-এস্-এ হোলির শুভেচ্ছা জানায়। আরো পাকা-পোক্তো হলে মাল্টিপ্লেকসে ঘুরে বেড়িয়ে চাড্ডি ফাস্ট ফুড খেয়ে দেয়ে দিব্যি করে বাড়ী ফেরে। দোল কেবলই ছুটির দিন একটা।

যেসব বাড়ীতে দোলের বৈঠকী বসে তারা অবশ্যই এর ব্যতিক্রম। সেখানে গানের আড্ডা বসে সকাল থেকে, যেখানে ব্রজগোপীদের র্ং খেলা থেকে শুরু করে গৌর আবির্ভাব্, পুরাতনী, রবীন্দ্র্নাথ্, নজরুল সকলকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়ে। আজ আমাদের দোলের আগের রাতে ন্যাড়া-পোড়া হাতে গোনা যায়। পর্যাপ্ত প্লাসটিক পূর্ণ পরিবেশে ন্যাড়া-পোড়া নিষিদ্ধ। বিদায়ী বসন্তের সাথে সাথে পুরানো আবর্জ্জনার দহন পরিবেশকে কিছুটা মুক্ত করে "মুছে যাক্ গ্লানি" , ঘুচে যাক্ মলিনতার সংগে নতুন বছরকে "এসো হে বৈশাখের" বার্তা শোনাতে পারত, কিন্ত আজকের দিনে ন্যাড়া-পোড়া আযোজন করবে কে? কোথায় বা আছে খোলা মাঠ?

এখনকার ট্রেন্ডি-টিনরা এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়না। আমরা কত উন্নত ও যান্ত্রিক হয়েছি আজ। Motion-এর চাপে সব Emotion উবে গেছে কর্পূরের মত ।দোল প্রতি বছর পরিযায়ী পাখীর মত আসবে আবার চলেও যাবে। কিন্ত দোল খেলায় থাকবেনা মাতামাতি, রং খেলায় হবে না কোন চ চাঞ্চল্য । বরং পরিশীলিত এবং মার্জিত রূচিবোধের অভাবে রং খেলা হলে , হবে খুনোখুনি কিংবা রংএর বদলে রক্ত গঙ্গা বইবে। মোটর সাইকেলে ট্রিপল ক্যারি করে বন্ধুকে নিয়ে কানে আই-পড লাগিয়ে বিকট চিত্কার করে দোল খেলা চলবে বহুত রাত অবধি, কো-এড কলেজে আবীরের বদলে সিঁদুর চলবে, অথবা দোলখেলাকে কেন্দ্র করে বন্ধু-বন্ধুতে ঝগ্ড়া এমন পর্য্যায় চলে যাবে যা থেকে অয্থা প্রাণ হারাবে একটি বন্ধু অপর বন্ধুর গুলিতে। কত স্বামী-স্ত্রী তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে স্মরণ করবে তাদের একটুকরো দোলের "একটুকু ছোঁয়া লাগে"র সুখস্মৃতি;

আজকের কালের আবর্তণে ঘুরন্ত পৃথিবীর ছুটন্ত মানুষের উত্তেজনা, উদ্দীপনা-বহুল দোল মানে হাতে বিয়ারের ক্যান কিংবা শপিংমলে কিছুক্ষণ !!!

Wednesday, February 24, 2010

তুলনাহীনা রে

 (পর্ব ৪)

আমার কল্পনাট্যের কুশীলব শ্রেয়সী- সোহম সে ফাগুনের এক ভোরে 
বায়ুপথে পাড়ি দিল ডালাস থেকে নিউইয়র্ক 
সেখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে সোজা ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথে.. 
ডিসির রাজপথ হোয়াইট হাউসের রাজকীয় শুভ্রতায় কি অসাধারণ শন্তিময়তা 
বাইরের সবুজ লনে কি সুন্দর সজীবতা সাথে গেরুয়া মরশুমি ফুলের উজ্জ্বলতা 
এই তিন রঙ মনে করিয়ে দিল শ্রেয়সী কে তার নিজের দেশমাতৃকার কথা, 
মনে মনে সে প্রনাম জানাল তার নিজের ত্রিরঙা কে 
ক্যাপিটল হিলের কাছে লিংকন মেমোরিয়াল 
চির শুভ্রতায় জ্বাজ্জল্যমান  এব্রাহাম লিংকনের স্মৃতি নিয়ে,  
সেখান থেকে তারা গেল ন্যাশানাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে 
সেই বহু বিতর্কিত এবং অভিশপ্ত হোপ ডায়মন্ড দেখে আসে তারা 
ন্যাশানাল গ্যালারি অফ আর্ট থেকে এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়ামে এল 
তারা ঝুলন্ত ছোট বড় কত কত উড়োজাহাজের মডেল, আর তার বিবর্তন 
তার মধ্যে থেকেই উঠে এল স্মৃতির মণিকোঠা থেকে 
রাইট ব্রাদার্সের হাতে তৈরী প্রথম প্লেনের মডেল 
ক্লাস নাইনের ফিসিক্স ব‌ইয়ের সেই ছবি 
আজ ত্রিমাত্রিক মডেল হয়ে ঝুলছে চোখের সামনে 
শ্রেয়সী-সোহম বাকরূদ্ধ হয়ে যায় " এও দেখা হয়ে গেল তাহলে!"
ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশানাল গ্যালারী অফ আর্ট এ এসে পৌঁছায় তারা 
সোহমের বহু প্রতিক্ষীত ভাবনালোকের রূপসাগর
সোহমের মুখ থেকে শুনে শুনে শ্রেয়সীও ডুব দিল সেই রূপসাগরে 
ইম্প্রেশানিস্ট, স্যুরিয়ালিস্টিক সবরকমের পেন্টিংয়ের সাথে হাতেখড়ি হল তার ! 
Matisse, Rennoir, Claude Monet, Van Gogh, Paul Gauginর গল্পে 
মাত হয়ে গেছিল আর্ট গ্যালারির প্রতিটি করিডোর ! 
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হোল Da Vinciর আর এক বিরল সৃষ্টি দেখে 
যা মোনা লিসার থেকে কোন অংশে কম নয় 
মোনালিসার হাসি নেই তাতে কিন্তু সেই ভয় মিশ্রিত গাম্ভীর্য্য 
অনবদ্য লাগল তাদের 
বিদায়ের সময় শ্রেয়সীর মনে হল 
ডিসি তুমি দিগবসনা, সবুজ আঁচল শুভ্ররাজবেশে ছড়িয়ে দিয়েছো নীলের দিগন্তে 
সৌন্দর্য তোমার অলংকার, রাজকীয়তা তোমার মজ্জাগত, নিয়ম শৃঙ্খলা তোমার সহজাত, 
বেঁচে থাকো ডিসি তোমার অমলিন স্বর্গীয় রাজকীয়তা নিয়ে

Saturday, February 20, 2010

Test Post

Created on 21 02 2010
...........................

Saturday, February 13, 2010

প্রেমের দীপাবলী

এই তো সেদিন তোমার সাথে লুভার মিউজিয়ামের করিডোরে লুকিয়ে,
ভার্সাই প্যালেসের প্রতিটি দরজা, কাঁচ ছুঁয়ে,
এই তো সেদিন পৌষমেলায় টেরাকোটার চাঁদের হাটে...
আমার সবকিছু আজ দেব তোমায় আমার সব অহংকারের বোঝা, 
পাগলামি, পাপপুণ্যের ফিরিস্তি, ধোপা-কাগজওয়ালার হিসেব থেকে শুরু করে সব কিছু,

আমার অভিশপ্ত যৌবনের অঙ্গীকার,
আমার অস্পষ্ট কৈশোরের আবছায়ায় তুমি ছিলে একদিন
আজ আমার যা কিছু তা তোমার জন্যে  

প্রেমের দীপাবলী জ্বলছে চেয়ে দ্যাখো,
নানাদেশের বিচিত্র সব প্রেমের দেবদেবীরা
সেই প্রেমের যজ্ঞে আহুতি দিলেন ভ্যালেন্টাইন !
হৃদয়ের একূল ওকূল সব উজাড় করে দিলেন
আর দিলেন শীতের ওম্‌, বসন্তের কোকিলের গান
প্রেমের শতদলেরা জেগে উঠল....
ছাড়পত্র পেল তোমার ঘরে যাবার

যে নীল এতদিন খুঁজেছিলাম ল্যাবটারির কপার সালফেটের কাঁচের শিশিতে
সেই নীল আজ আমার,
যে সবুজ এতদিন ছিল ফেরাস সালফেটের ক্রিস্টালে
তা এখন আমার মনে,
সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ধূলোপড়া জার্নালে খুঁজেছো আমায়,
খুঁজেছো ব্যস্ত কফি হাউসের নিঃস্ব টেবিলে 
আজ আমি শুধুই তোমার,
দূর থেকে দন্ডায়মান ভ্যালেন্টাইন আশির্বাদ করুণ !
বেঁচে থাকুক সব প্রেম-অপ্রেম, সব স্মৃতি-বিস্মৃতি
রডোডেন্ড্রণের উদ্ধত শাখার শিখর আলোকিত করে 

বেঁচে থাক প্রেমের কবিতারা
সেই সব অমিত লাবণ্যেরা, মালতীবালা স্কুলের সেলাই দিদিমণিরা
আর বেচারা বেণীমাধবেরা

Monday, January 25, 2010

নয়নভুলানো এলে

পর্ব (৩)

একদিন তারা পাড়ি দিল  লুইসিয়ানা স্টেটের পুরোণো শহর নিউঅর্লিন্সের পথে,
ফ্রেঞ্চকোয়ার্টার ছিল এককালে, তাই ফরাসী ঐতিহ্য বহমান এখনো রাস্তার মাঝে
ধারে ধারে ক্ষুদে চিত্রশিল্পীদের শিল্পকলা, বাদ্যশিল্পীর জ্যাজ অনুশীলন,
প্রাসাদোপম অট্টালিকার আধুনিক বুটিকে রূপান্তকরণ 
যেন অধুনা অমুক নং বালিগঞ্জ প্লেস অথবা তমুক নং ল্যান্সডাউন টেরেসে
নামজাদা ডিজাইনার বুটিক!
আর তারা দেখলো নয়নভোলানো সব আর্টগ্যালারি,
মিসিসিপিবক্ষে ভেসেছিল সেদিন দুজনে..
শ্রেয়সীর ভূগোল ব‌ইয়ের ইতিহাস আজ তার সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে
স্রোতের সুর তুলে নীলঘাগরার কুঁচি লুটিয়ে,
মিসিসিপির ডেকে বসে দেখেছিল সূর্যাস্তের লাল রঙ
ওপারের সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রাল সাক্ষী হয়ে দেখেছিল সে বিকেলে
সোহম্‌-শ্রেয়সীর প্রেমের পরব !
চমকে গিয়েছিল তারা নিউঅর্লিন্সের বুকে লাল ট্রাম দেখে,
মজার শহর নিউঅর্লিন্স সকলে নিজের খেয়ালখুশিতে চলে

কোনো সময়ের অভাব নেই, নেই কোনো একঘেয়েমি 
কোনোবাড়ির পোর্টিকোতে গীটারে জ্যাজ বাজায় তরুণ,
কোথায় আবার বিউগল বাজিয়ে ভিক্ষা চাইছে যুবক,
কোথাও আবার একর্ডিয়ানে সুর তুলতে ব্যস্ত কোনো শিল্পী
সেন্টপিটার্স স্কোয়ারে নামা-অনামা কত শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনী চলছে,
যেন  ফ্রান্স শহরের পুরোনো সাবেকিয়ানা এখনো ব‌ইছে 

নিউঅর্লিন্সের কোণায় কোণায়,
শহরের প্রাণকেন্দ্র ল্যাটিন কোয়ার্টার "Vieux Carre" 

আজও ফরাসীয়ানায় অমলিন
রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, সাবেকি স্ট্রীটল্যাম্প 

বিখ্যাত বুরবন স্ট্রীট আজও ব্যস্তময়!বর্ণময়
সোহম্‌ সেদিন শ্রেয়সীকে টেকিলা উইথ মার্গারিটা খাইয়েছিল, 

এখানকার বিশেষ পানীয়
সেদিন প্লেটে সুসজ্জিত কেজুন রাইস আর ক্রফিস কারি নিয়ে 

তারা পৌঁছে গেছিল পার্কস্ট্রীটের চাইনিস রেস্তোরাঁয়, এক নস্টালজিয়ায়....
মিসিসিপিকে বিদায় জানাতে বড় কষ্ট হয়েছিল শ্রেয়সীর,
মনে মনে বলেছিল ঠিক এমন করেই থেকো তুমি যেমন আজ আছো,
তোমার আকাশ আমার আকাশের চেয়েও নীল দেখে যাচ্ছি
তোমার জলের রং আমার চোখের তারায় ধরে নিয়েছি
তোমার আকাশে সেদিন দেখেছি পড়ন্ত সূর্য়ের লাল-কমলার খেলা
জলের ওপরে সেই ছায়া আর তার ওপরে আমাদের ছবি
তা তুমিও কিন্তু রেখো ধরে সুন্দর করে.. 
শহর নিউঅর্লিন্সকে বলেছিল যদি তুমি হারিয়ে যাও একদিন
যদি কোনো বিধ্বংসী ঝড় এসে তোমায় গ্রাস করে নেয় 

তোমার ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না,
তুমি হয়ত তলিয়ে যাবে 

কিন্তু আমার মনের ক্যানভাসে তুমি বেঁচে থাকবে চিরসুন্দর হয়ে 
 

Thursday, January 21, 2010

মধুরাতি হবে ভোর


পর্ব ১

প্রেমের জোয়ারে 
 

১৯৮৯ র ফাল্গুন, ২৩য়ের উদ্ভিন্নযৌবনা শ্রেয়সী,
বিয়ের অষ্টমঙ্গলা সেরে মধুচন্দ্রিমা...
সুদূর ডালাসে পাড়ি দেওয়া,
অপরিচিত, অজানা অথচ অতি কাছের
জীবনের প্রথম প্রেমিকের সাথে,
বহু প্রতীক্ষিত বায়ুপথে ভ্রমণ..
বিমানবন্দর থেকে একে একে চোখের বাইরে চলে গেল
মা, বাবা আর ভাইয়ের ছলছল চোখ,
শ্রেয়সীর চোখে তখন ব‌ইছে আনন্দাশ্রু,
নিমেষে কষ্ট উধাও হয়ে গেল, 
হাত ধরল কাছের মানুষটি,
অনাবিল আনন্দে হারিয়ে গেল তারা । 
 

বিশ্বভরা প্রাণ 

আমেরিকার মাটিতে পা দিয়েই শ্রেয়সীর মনে হল
ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধন্য এই দেশ,
কত সুন্দর সৌজন্যবোধ মানুষের, সুন্দরের সত্য পূজারী তারা,
তারা কত রুচিশীল, সত্যিই তারা গড়তে জানে নিজেদের
আর ভালবাসে তাদের দেশকে, 
রক্ষা করতে পারে ভগবানের সৃষ্টিকে,
আর নিজেদের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে,
উজাড় করে দিতে পারে বিশ্বের দরবারে;
তুমি বলবে কৃত্রিমতা এ শতাব্দীর অভিশাপ
শ্রেয়সী তা বিশ্বাস করেনা,
কৃত্রিমতা যদি উন্নতি ঘটায় তাহলে বাধা কোথায়?
বিজ্ঞান যদি কাজের বন্ধু হয় তাহলে আপত্তি কিসে ?
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে আমরা বাঁচিনা একটু সহজ করে, সাবলীল ভাবে!
আসলে যে দেশের নাগরিকের চিন্তাধারা সুস্থ, যারা সভ্যতায় পরিপুষ্ট,
বিধাতাপুরুষ বোধ হয় দুহাত তুলে তাদের আশীর্বাদ করেন..
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্যে, প্রাকৃতিক জলবায়ুর মিষ্টতায় 
দেশের মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রোজ তারা প্রণাম জানায় দেশমাতৃকাকে|


পর্ব ২
ধরা দিয়েছি গো  
 
ভোরবেলা শ্রেয়সীর কিচেনের ব্লাইন্ডস সরিয়ে
ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামসের পার্কিং লটে তাকিয়ে থাকা
সার সার গাড়ির ছাদে দুধসাদা বরফের চাদর
তার সাথে সূর্যের আলোর মাখামাখি,  
সেই জানলা দিয়েই রোজ সোহম্‌কে বাই করা,
২৭য়ের সুপুরুষ সোহম্‌ ম্যানেজমেন্ট স্কুলে তখন,
দুপুরবেলা বান্ধবীদের সাথে শপিংমলের হাতেখড়ি  
একরাশ বিদেশী পারফিউমের গন্ধ নিয়ে ফিরে আসা,
বিকেল হলেই নতুন জলখাবার তৈরী আর সোহমের জন্য প্রতীক্ষা...
তারপর শ্রেয়সী রোজ চোখ রেখেছে অপার বিস্ময়ে,
কখনো ডালাস ডোমের মাথায় গরম কফি হাতে,  
কখনো টাইলার রোজ গার্ডেনের গোলক ধাঁধায়,
কখনো নেচে উঠেছে তার প্রাণ টার্নার ঝোরার ধারে,
গুহার ভেতর জাপটে ধরেছে তার সঙ্গী মনের মানুষটিকে,
গেয়ে উঠেছে মুক্তির আনন্দে, নেচে উঠেছে ঝোরার জলের ছন্দে,
ল্ংড্রাইভে এল্.বি.জে এক্সপ্রেস ওয়ের ওপর
কতবার ছুটেছিল তাদের সাদা মাজদা ৬২৬
শ্রেয়সীর খোলাচুল উড়ে এসে পড়েছিল তার প্রিয় পুরুষটির কাঁধে
ডালাসের ফাগুনে সেদিন ছিল শ্রেয়সীর প্রেমের আগুণ, প্রাণের মূর্ছনা   
রিচার্ডসনের রাস্তা, প্লেনোর পথঘাট সে ফাগুনে দেখেছিল নতুন বসন্ত  (ক্রমশঃ)

Thursday, January 14, 2010

পুরুষের প্রকৃতি


যদি বলি আকাশ মাঝে কিসের এত আলো, কেন‌ই বা সেই আলোয় দেখি ঝলক,
তুমি বলবে সেই আলোর‌ই মাঝে আছে যেন নতুন প্রাণের চমক |
যদি বলি সবুজ ছোঁবে নীলের সীমা, সাদায় বাঁধা শুক্লাতিথির আলো,
আমার হাতে তোমার হাতের ছোঁয়া, সঙ্গে শুধু প্রেমের আগুন জ্বালো |
ভোরবেলাতে বালক আলোর তুমি, আমি তখন পাখির গানের সুরে,
তোমার আলোয় আমার ফুলের দেশে পাপড়ি মেলে কিম্বা ঝোরে পড়ে |
বেলার শেষে দুপুর নৌকাখানি ক্লান্ত স্রোতে ভাটিয়ালির সুরে,
আমার নদীর নরম ঠান্ডা হাওয়া তোমার ডিঙি আলগোছে পার করে |
বিকেলবেলায় কাজের খেয়া নদীর তীরের কাছে আসে,
দুজনাতে একটু দেখা, দুই প্রাণেরই সরলরেখায়, দুজনাতে বসে পাশে,
অস্তাচলে সন্ধ্যারাগের রাগরাগিনী বাজাও তুমি,
পূব আকাশে চাঁদের হাসি মাখিয়ে ক্লান্ত পায়ে চলি আমি |
তোমার আমার বাড়ি, মেঘেরা তার ওপর বাঁধে ঘর,
সেই ঘরের‌ই ছাদের পরে মেঘ ভেসে যায় কোন সুদূরে,
তোমার আমার চেনা সেই পথ |
যদি বলি একটু সবুজ করে ভেবো আমায়,
যা তুমি চাও দেবো তোমায় আমি,
কৃষ্ণচূড়ার আগুণ দেখে এসে ভুলোনা কো আমার সবুজ সে মন |


picture courtesy : Niren Sengupta